Tuesday 29 May 2018

বাবাই



১।।

আমার জন্ম হাওড়া জেলার , রামরাজাতলায় । ওখানে আমার মামার বাড়ি ।। মা ওখানকার বিখ্যাত মন্ডল বাড়ির মেয়ে । ঐ যে যেটাতে দুগ্গা পুজো হয় , ঐ বাড়িটা ।। মায়ের বাবা , গণেশচন্দ্র মন্ডল সেকালের এক বড় জমিদার ছিলেন বলা চলে । বিশাল সম্পত্তি । এছাড়া কলকাতার রাধাবাজারে মায়েদের ঘড়ির ব্যবসা ছিল । সে যুগে খুব নাম করা দোকান , খুব বিক্রি ।। মায়ের মুখেই শুনেছি , দাদু রোজ রাত দুটো নাগাদ রাধাবাজার থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি আসতেন । প্রচন্ড পরিশ্রমী ছিলেন , তেমনি সাহসী । রাতে বাড়ি ফিরেও শান্তি ছিল না । দোকানের বাকি কাজ তিনি রাত জেগে শেষ করতেন । এছাড়া দাদুর একটা মস্ত গুন ছিল , তিনি অন্যের উপকার করতে খুব ভালোবাসতেন । কত গরিব লোকেদের তিনি জমি দান করেছিলেন সে সময়ে তার হিসাব নেই । এতো অনিয়ম শরীর বেশি দিন সহ্য করতে পারলো না । খুব অল্প বয়সে তিনি মারা যান । মা ও বাকি চার বোন আর দুই ভাই তখন খুব ছোট ।। 
আমার দিদা রেবা দাস । দেখতে অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন । গৃহবধূ হলেও তিনি সে যুগে কলেজ পাস ।। দাদু মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরেন বাড়ির বড় ছেলে ; ভোলানাথ মন্ডল ।। শুনেছি মায়ের বিয়ে তিনি নিজে খোঁজ খবর নিয়ে দিয়েছিলেন ।।
এ তো গেল মায়ের বাড়ি ।। বাবা চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানায় চাকরি করতেন ।। বাবারা পাঁচ ভাই ও তিন বোন ।। এদের পরিবারের ইতিহাসটা বেশ প্রাচীন ও বড় জটিল ।। পরে বলবো এক সময়ে ।
আমার জন্ম হয় রামরাজাতলায় , বাগচির নার্সিংহোমে । সেদিন মহালয় । মামার বাড়িতে পুজোর বাঁশ পরে গেছে ।। খবর এলো , ছেলে হয়েছে ।। রীতিমতো হৈ হৈ ব্যাপার ।। বড় মামা শখ করে নাম রেখেছিল চুল্লু ।। খুব ভালোবাসতো আমাকে । তবে আমার নাম , সন্দীপ টা বাবার রাখা আর ডাক নাম বাবাই টা মা রেখেছিল , যদিও এ সবই আমার শোনা কথা ।।
আমার প্রথম ছ মাস কেটেছিল , মামার বাড়িতেই । মামার খুব ইচ্ছে ছিলো , এখানেই ভাত দেবে । কিন্তু শেষ মেস হয়নি । বাবারা আমায় ও মাকে নিয়ে চলে আসে চিত্তরঞ্জন ।। আমার জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় এবার ।
আমার বাবা , খুব ভালো গোলকিপার ছিলেন । জীবনে কত গোল , কত সহজে আটকেছেন তার হিসেব নেই । এর থেকেও বড় পরিচয় তিনি একজন পর্বতারোহী ছিলেন । কত শৃঙ্গ জয় করেছেন , পেয়েছেন কত নাম আর সম্মান । তবে এতে জীবনের ঝুঁকিও অনেক থাকে । প্রায় দু তিন বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন । তবে প্রকৃতির টানে সারা দেবে না , এমন পাগল কেউ হতে পারে বলে জানা নেই আমার ।।
ছোটবেলা থেকেই বাবা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল । সারাদিন তার সাথেই গল্প করে , খেলে চিত্তরঞ্জনের বুকে শিশুকাল কাটছিল আমার বেশ দারুন ভাবেই ।। রেলে চাকরি হওয়ার দরুন বাবা ট্রেনে ফ্রি এসি পাস পেতেন , তাই ঘুরে বেড়ানোটা আমার কাছে বেশ আরামদায়ক ছিল ।।
আর একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল , বাবার কেনা এল এম এল ভেসপা স্কুটার ।। রোজ আফিস যাবার আগে বাবার গাড়িতে চেপে বেশ কিছুটা ঘুরিয়ে আনতে হবে আমায় । এই ছিলো আমারফরমান । আমার জন্মের পরে ওই পাড়ায় অনেক ছেলে মেয়ের জন্ম হয় । ফলে বেশ আনন্দে কাটছিল আমার শৈশব কাল ।। সবাই বলতো , বাবাই নিজের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে ।। এতো বুঝতাম না , তবে এই আনন্দটা বেশ উপভোগ করতাম ।। ঘোরা , বেড়ানো , খেলা , পিকনিক , ন্যাড়া পোড়া , দোল , স্বরস্বতী পুজো সব সময় আমরা উপভোগ করতাম এক সঙ্গে ।।
দেখতে দেখতে বড় হতে লাগলাম । স্কুল জীবন শুরু হলো আমার ।। বাবার হাত ধরে ভর্তি হলাম , সেন্ট জোসেফ নার্সারি এন্ড কেজি স্কুলে ।। তখন , আমার বয়স চার কি পাঁচ হবে ।।

২।।

প্রথম স্কুলের প্রথম দিনটা আমার খুব মনে পরে । সকাল ছটা থেকে স্কুল শুরু । সঙ্গে বাবা গেছিলেন গাড়ি নিয়ে ।। নতুন জামা প্যান্ট পরে , এক নতুন জীবনের অধ্যায়ের সূচনা করতে চলেছি আজ ।। তবে একটা জিনিস বোধহয় জানা ছিল না , যে স্কুলের ভিতরে বাবা বা মা কারুর প্রবেশ অধিকার নেই ।। আমাকে ছেড়ে বাবা চলে যেতেই সজোড়ে কান্না শুরু ।। তখন আমাকে কে আটকায় ।। যদিও অনেক কষ্ট করে সিস্টার রা নিয়ে যায় ভিতরে ।।
ভিতরটা খুব অদ্ভুত ।। চারদিকে টেবিল , চেয়ার ।। ক্লাস শুরু হলো , সেদিনকার মতো ।। এই চার্চের দুটো জিনিস ভোলা যাবে না কোনোদিন ।। প্রথমটি হলো আমাদের ব্যাচের একটি ছেলে ।। রোজ ইস্কুলে এসে প্যান্টে পায়খানা করে ফেলতো আর সেই গন্ধে ক্লাস বন্ধ করার মত অবস্থা তৈরী হতো , একদিন বা দুদিন নয় , এ ছিল তার রোজের কাজ । যেন বাড়ি থেকে পরিকল্পনা করে আসতো সে ।। অরিন্দম বোস , আমার প্রথম স্কুলের সেই ছেলেটি পরবর্তীকালে আমারবেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে ওঠে ।।
দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য জিনিসটি হলো স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানটি ।। পতাকা উত্তোলনের পর চেঁচিয়ে সুভাষ চন্দ্র , মহাত্মা গান্ধী ও চাচা নেহেরুর নাম নিয়ে জয় বলতে হত । কে কি বলতো জানি না , আমি যা বলতাম তাতে অন্তত সবার মুখে খুলে হাসির বন্যা বয়ে যেত - বাস ছন্দ বোস , আত্মা চান্দি আর আলকাতরা নেহেলু এই তিনজনের নাম নিয়ে জয়ধ্বনি দিয়ে এসেছি , বছরের পর বছর ।।
সবাই আমাকে খুব ভোদা বলেই জানতো । জিনিস হারানোর মাস্টার ছিলাম আমি ।। তাই বাবা যখন বাড়ি নিয়ে যেতে আসতো , রোজ আমার ব্যাগ চেক করতেন।
এই স্কুলেও আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেও ।।
সবাই বলেছিল , বাংলা মিডিয়ামএ পড়াতে ।। বাবার জেদ , ছেলে ইংলিশ মিডিয়াম এ পড়বে , আর তাই করলেন । এই স্কুলে আমার অনেক নতুন বন্ধু জুটলো , যাদের আগে দেখিনি কোনোদিন ।। 
তবে সবাই যে ভালো তা নয় , অনেকেই আমাকে বোকা পেয়ে জিনিস চুরি করতো , এটা অনেকবার দেখা গেছে । তবে , চোরটা যে কে সেটা ধরতে পারিনি কোনোদিন ।। নতুন স্কুল , নতুন পরিবেশ ।। ক্লাসের টিচার রা কিন্তু খুব ভালোবাসতো আমায় , কারণ রোজ পড়া করে আসতাম স্কুলে ।। অবশ্য তার জন্য দায়ী ছিল আমার বাবা ।। কত মার খেয়েছি তার কাছে এই পড়া নিয়ে ।। একবার তো নাক ফাটিয়ে দিয়েছিল , অঙ্ক পারছিলাম না বলে ।।
স্কুলের টিচারদের মধ্যে মনে সবাই পরে । সেই বন্দনা ম্যাম , মধুমিতা ম্যাম এর ক্লাস বা সিকদার স্যার এর ডায়লগ , এই শালা হারামির দল , আজও খুব খুব মিস করি ।। 
একদিন কোন কারণে স্কুল আগে আগে ছুটি হয়ে যায় । বাবা আসেনি দেখে , আমার তো চোখ লাল , কান্না জুড়ে দিলাম ।। যাক , বেশি কাঁদিনি । বাবা এসে গেছিলো তাড়াতাড়ি ।। এইটুকুই ছিল আমার পৃথিবী ।। আজ খুব মিস করি এগুলো ।। এই স্কুল নিয়ে বলতে গেলে রাত পেরিয়ে যায় ।। মনে পরে বালিকে , মনে পরে কল্লোল , অভিষেক , সুমিত , সৌভিক , ওয়াসিম , তুহিন , রবিন , ধীরাজ বা জিসান কে ।। তবে বেশি মনে পরে আমাদের লম্বু শুভম গাঙ্গুলি কে ।। সারাজীবন প্রথম বেঞ্চের জন্য লড়ে গেল , কিন্তু পরীক্ষায় সেই লাস্ট বেঞ্চ । এই হলো শুভম ।। একদিন স্কুলে নিয়ম হলো , হাইট ওয়াইস বসতে হবে ক্লাসে ।। সেদিন প্রথম বেঞ্চের জন্য লড়তে দেখেছি ওকে ।। এ নিয়ম নাকি সে মানে না ।। 
দ্বিতীয় জন হলো শঙ্খ শুভ্র , আমার সঙ্গে বসত ।। ও ক্লাসে প্রথম হত আর আমি দ্বিতীয় ।। জুটিটা ছিল ভালো ।। ওদের সঙ্গে যেন পারিবারিক সম্পর্ক ছিল , যেন হরিহর আত্মা ।।
আর তৃতীয় জন অরিত্র মন্ডল ।। ক্লাস ফোর এর পর চলে যায় , তারপর থেকে তার কোন খোঁজ পাই নি আজ ও ।। অবশ্য সেই শুভমের সৌজন্যে ফেসবুকে রিসেন্টলি তাকে পাওয়া গেছে ।।

৩।।

ক্লাস ফাইভ ।। স্কুল এস্কারসনের খবরটা পেয়েই ঝিমিয়ে পরা শরীর মন বেশ জাঁকিয়ে বসলো ।। জীবনে প্রথম বার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবো । উফ !! ভাবতে পারছি না ।। সেইমত , রিজার্ভেশন করানো হলো স্কুল থেকে । যাওয়া হবে দিল্লি ঘুরতে ।। ট্রেন পূর্ব এক্সপ্রেস । সে সময়ে রাজধানীর পরেই ছিল এই ট্রেনটি ।। 
আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল যে দেওয়া ব্যাচটি সারাদিন হাতে বেঁধে রাখতে হবে ।। আসলে ওই ব্যাচএর রং বলে দেবে কে কোন টিচার এর আন্ডারে আছে , যেমন আমারটা লাল রঙের , মানে আমি সঞ্জীব স্যারের হাতে থাকলাম এইরকম আরকি ।। 
ট্রেন ছাড়লো দুপুর বারোটা দশ । ট্রেনের ভিতরে তখন এক উৎসবের মেজাজ । দুটো বগি আমাদের ফুল রিসার্ভ ।। কেউ গান শুনছে , কেউ গান গাইছে , আবার কেউ দাবা খুলে মগজে শান দিচ্ছে ।। আর কেউ কেউ ট্রেনের স্টপেজের নাম খাতা খুলে নোট ডাউনে ব্যস্ত ।। সে কি আনন্দ !
দেখতে দেখতে রাত হল । জানতে পারলাম আমি ওপরের বার্থ পেয়েছি । এই যা , ওটি তো পারি না । আমার লোয়ার চাই ।। সে এক অবস্থা ।। অবশেষে অর্পনের সহযোগিতায় লোয়ার পেলাম আর ও আমার ওপরে ।।
খুব মনে পরছে ওই একটি ফ্রি তে একটি ফ্রি ঘটনা টি ।। ট্রেন এর যে হকার যাচ্ছে , কিছু দিয়ে যেতে হচ্চিল আমাদের , এ ছিল আমাদের ডিমান্ড ।। আর না দিলে , ওপরে বসে থাকা ছেলেরা লুট করে নিচ্ছিল অজান্তে , যেটা ঘটেছিল সেই ছোলা ওয়ালার সাথে ।।
ট্রেন ঢুকলো সকাল নটা । স্টেশন থেকে সোজা হোটেল ।। ঠিক হোটেল নয় , দিল্লির কালীবাড়ি ।। সেখানে ব্যাগ রেখে ঘুরতে বেরোবো এটাই ঠিক আছে ।। কিন্তু পথে যে আমার মত ঢপের ছেলে যাচ্ছে , সেটা ভুলবেন না যেন ।। ঠিক কেলো বাঁধিয়ে দিলাম রাজঘাটে এসে ।। বাসেই সর্বনাশ ।। ওটা যে আমার ধাতে সয় না আবার ।। বমিতে চারদিক ভর্তি ।। রাজঘাটে , খালি গায়ে বসে কাটালাম আমি আর বাকিরা ....

৪II

দিল্লি দর্শন এর গল্প তো শোনালাম , এবার চলুন আমার পিতৃ পরিচয়ের দিক টা উন্মোচন করা যাক ।। চিত্তরঞ্জন শহর তখনও তৈরি হয়নি যখন আমাদের বংশ উত্তর কলকাতার বনেদি ছিল ।। বউবাজার মোলঙ্গা লেন , এই ছিল আমাদের আদি ঠিকানা ।। বিশাল মার্বেল এর মোড়া বাড়ি ।। সামনে বিশাল দুর্গা দালান ।। বিশাল ঘটা করে পুজো হত সেখানে ।। মা র মুখে শুনেছি অষ্টমীর দিন আড়াই মন চালের ভাত মা কে প্রসাদ দেওয়া হত ।। 
আমার পর ঠাকুরদার ছিল গরম কাপড়ের দোকান ।। তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে সে দোকানের বিশাল নাম ছিল ।। তার পিছনে অবশ্য দুটি কারন ছিল ।। প্রথমত আমার পর ঠাকুরদা নিজে , নাম গণেশ চন্দ্র দাস ।। ভদ্রলোক চোখে ভাল দেখতে পেতেন না কিন্তু শুধু হাতের ছোঁয়ায় খুবই অনায়াসে নির্ধারণ করতে পারতেন কার শরীরে কোন কোটটি মানাবে ।।
দ্বিতীয়জন ছিলেন দোকানে র মিস্ত্রি ।। জাতে মুসলমান , কিন্তু আমাদের বাড়িতে জাতপাতের ভেদাভেদ না থাকায় , আমাদের বাড়িতেই তার আশ্রয় জুটেছিল ।। শোনা যায় যে কোন ব্যক্তিকে খালি চোখে দেখেই তিনি অনায়াসে তার মাপ নিতে পারতেন ।।
পর ঠাকুরদা মারা যাওয়ার পর সেই সম্পত্তির দায়িত্ব এসে পড়ে আমার ঠাকুরদা নগেন্দ্রোনাথ দাসের হাতে ।। মান্না দে , ছিনাথ বহুরূপী প্রভৃতি বিখ্যাত লোকেদের বাড়ি দ্বারা বেষ্টিত এই সম্পত্তির হিসাব কত হতে পারে তা আপনারা নিশ্চই আন্দাজ করতে পারছেন ।। আমার ঠাকুমা সে যুগের গ্র্যাজুয়েট ছিলেন ।। অবিভক্ত বাংলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পাস করেছিলেন ।। তার বাবা ঢাকা ও কলকাতা উভয় বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রফেসর ছিলেন ।। তাদের বাড়িতে একটি ফিটন গাড়ি ছিল এবং তাতে চেপেই ঠাকুরমা কলেজ যেতেন ।। এত উচ্চশিক্ষা পেয়েও কিন্তু তিনি নিজের সংস্কৃতি বিন্দু মাত্র ভোলেন নি ।। বরং দুর্গা অষ্টমীর ভাত তিনি নিজে হাতে মা কে নিবেদন করতেন ।।
এই রকম একটা পূজার দিন , তিনি আড়াই মন চালের ভাত যখন দেবী কে নিবেদন করছেন , ঠিক সেই সময় ভাত টি চার ভাগ হয়ে পড়ে যায় ।। কোন এক অশুভের গন্ধ পেয়ে তিনি মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন ।। এত উচ্চশিক্ষিত হয়েও এমনই ছিলেন আমার ঠাকুরমা ।। এর কিছুদিন পরেই অসুস্থ হয়ে ঠাকুরদার মৃত্যু হয় ।। পুরো দায়িত্ব ঠাকুরমা র হাতে এসে পড়লেও তিনি কোনদিন পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে কে কষ্ট পেতে দেননি ।। কিন্তু সে টুকুও সুখ তাদের ভাগ্যে টেকে নি ।। প্রাক স্বাধীনতা দাঙ্গায় তাদের ভিটে মাটি হারাতে হয় ।। এর পর বাকিটা বর্তমান ।। বাবা সমেত তিন ভাই চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানায় যোগ দেয় , যদিও বাবার চাকরি পাওয়ার গল্পটি আরো লম্বা , সেটি পরে বলছি ।। সেজ জ্যেঠু পুলিশে যোগ দেয় ও আর এক জ্যেঠু আমেরিকান এক্সপ্রেসে যোগ দেয় ।। এভাবেই কলকাতার এক বনেদি পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল ...

৫II 
ঠাকুরদা মারা গেলেন ; অতো বড় জমিদার বংশ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল ঠিকই ; কিন্তু এসবকিছুর পরেও ঠাকুরদা একটি এমন জিনিস ছেড়ে গেছিলেন যা বাবাদের ভাগ্য ফেরাতে পারতো II দুর্ভাগ্য কিন্তু এখানেও আমাদের পরিবারের সঙ্গ ছাড়ে নি II ঠাকুরদার রেঘে যাওয়া এক ঘড়া সোনার টাকা যা বাগানে পোতা ছিল ; তার কথা তিনি কাউকে বলেননি II ঠাকুরদার মৃত্যু এবং সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর মায়ের মুখে শুনে জ্যাঠুরা সেই বাড়িতে হাজির হলে তাদের অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় , বলা হয় , "এরম কোন জিনিস বাড়িতে পাওয়া যায় নি ; এসব বুড়ির প্রলাপ মাত্র II " কিন্তু ভাগ্যের খেলা দেখুন , এই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই এক বিমান দুর্ঘটনায় তার দুই পুত্র মারা গেলেন II পুরো পরিবারটি এক মুহুর্তে নির্বংশ হয়ে গেল II 

এদিকে আমার দুই জ্যাঠা চিত্তরঞ্জনে চাকরির জন্যে চলে এলে ; আমার বাবা তাদের অনুরন করলেন এবং তেচ্নিক্যাল স্কুল এ ভর্তি হলেন II খেলাধুলায় ও ব্যবহারে খুবই ভালো হওয়ায় এখানে সবাই বাবাকে খুব ভালোবেসে ফেলে II এর দারুন এক নিদর্শন আপনাদের একটু পরেই দেখাবো II কথায় কথায় বলে রাখি , এই সময় সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে নক্সাল আন্দোলন শুরু হয় II আমার স্বপ্নের শহরো  এর গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নি II 

6||

তখন আমার বয়স ডের কি দুই বছর হবে || চিত্তরঞ্জন এ আসার পর থেকে ছোট খাটো জ্বর বা সর্দি কাসি হলেও ; রক্ত আমাশয় এর মতো কঠিন রোগ এই প্রথম স্পর্শ করলো আমায় || ডাক্তারের নির্দেশ মত ভর্তি হলাম কে জি হাসপাতালে || বাবা রেলে চাকরি করতেন বলে বিনামূল্যে হাসপাতাল সুবিধা পেয়ে থাকতাম আমরা || হাসপাতালটি বেশ বড় ; ডাক্তার রাও  বেশ ভালো || কিন্তু আমার এক্ষেত্রে কোনো ওষুধ বা ইনজেকশন কাজ করে নি ; জানিনা সেদিন ভাগ্যে কি লেখা ছিল !! টানা দশ দিন ওষুধ আর ইনজেকশনের ধকল একজন ডের বছরের বাচ্চার পক্ষে নেওয়া আর সম্ভব ছিল না || এদিকে ক্রমাগত পায়খানা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছিলো ||
আমার বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন ; তাই তার চিন্তা আমাকে নিয়ে ক্রমাগত বেড়েই চলেছিল || অধিকাংশ সময়ে হাসপাতালে কাটাতেন , অবশ্য আফিসের দিকটা তার বন্ধুরা না সামলালে এটুকু করা সত্যি দুরহ হয়ে পড়ত || সেদিন এটা বুঝতাম না ; কিন্তু বাবার শেষ সময়ে এটা বেশ বুঝেছি আমি || আজ তিনি সঙ্গে নেই আমার ; 11ই অক্টবর মহানবমীর রাতে তিনি মারা যান  ||
যাই হোক সে বিষয়ে পরে একসময়ে বলবো ; এখন নিজেতেই ফিরে আসা যাক || ক্রমাগত খারাপ হতে থাকা পরিস্থিতি যখন সবাই কে ভাবিয়ে তুলেছিল তখন মিসেস দত্ত ; যিনি ওই হাসপাতালে একজন নার্স ছিলেন , তার কথায় আমাকে ছুটি করিয়ে বাড়ি নিয়ে চলে আসা হয় এবং গাঁদাল ও থানকুনি পাতার রস খাওয়ানো হয় || অবাক কান্ড , কয়েক দিনের মধ্যেই রক্ত আমাশয় ম্যাজিকের মতো বন্ধ হয়ে যায় || এর পর থেকে পেটখারাপ হলে এই রীতিই বাড়িতে চলে আসছে ||
এছাড়াও , নিউমোনিয়ার জন্য আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় এবং এ ক্ষেত্রেও ডাক্তাররা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় আমাকে সুস্থ করতে || পরিস্থিতি জটিল হয়ে আসছে দেখে বাবা আবার হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে আসে এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শুরু করে ডক্টর ইউ কে দাস এর তত্বাবধানে || খুব ধীরে ধীরে হলেও তিনিই আমায় সুস্থ করে তোলেন || এর পর থেকে সর্দী বা কাশি হলেই অনেক বড় বয়স অবধি তার কাছে ছুটে যেতাম আর আমাকে দেখলেই তিনিও বেশ মজার সুরে বলে উঠতো ," কি রে আবার গলায় ব্যাঙ ঢুকিয়েছিস ?"
এ সব কিছু তো সামান্য ছিল ; ছেলেবেলা থেকেই আমি সোরাইসিসের পেসেন্ট || সোরাইসিস এমন একটি রোগ যার চিকিৎসা সম্ভব নয় আর এর প্রভাবে ত্বকের সৌন্দর্য প্রতিদিন হ্রাস পেতেই থাকবে || অবশ্য এর চিকিৎসার সমস্ত প্রচেষ্টা বাবা করে গেছে ; তবে সফল হননি || এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো পরের পর্বগুলোতে ||